শৈশবের ফেলুদা, কৈশোরের ক্ষিদ্দা আর যৌবনের বিশ্বনাথ মজুমদার



দৃশ্য ১
৩০ জানুয়ারী, ২০০৫

মফঃস্বলের একটা স্কুলের ১২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। স্কুলের টিচার্স রুমে বসে আছেন তিনি। নির্ধারিত সময়ে স্কুলের সামনের লনটা দিয়ে হেঁটে আসবেন মঞ্চের দিকে। টিচার্স রুমের চার-চৌহদ্দিতে তখন সাধারনের প্রবেশ নিষেধ। ক্লাস সিক্সের একটা ছেলে কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে অপেক্ষা করছে সেই মুহুর্তটার জন্য যখন তিনি এ পথে আসবেন! বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হল না তাকে, সেই মুহুর্তটা ঠিক এসে গেল। পাশে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর কিছু স্বেচ্ছা সেবকের বেষ্টনিতে তিনি এগিয়ে চলেছেন মঞ্চের দিকে। কালো ব্লেজার গায়ে গট গট করে হেঁটে আসছেন বছর সত্তরের ফর্সা, সুঠাম, মধ্যমণি সেই ‘যুবক’। ছেলেটা আর তাঁর বন্ধুরা মিলে ছুটতে ছুটতে ব্যারিকেড ভেঙ্গে তাঁর সামনে উপস্থিত।

“স্যার, একটা অটোগ্রাফ”

শুধু মাথাটা দু’দিকে নাড়ালেন তিনি। ব্যাস!

এক ঝটকায় ভলেন্টিয়াররা সরিয়ে দিল ওই ছেলের দল কে। স্টেজ থেকে নেমেও সেই একই আব্দারের মুখোমুখি। এবারেও না।

অটোগ্রাফটা আর পাওয়া হল না ছেলেটার।

কাট টু


দৃশ্য ২

৩০ জুন, ২০১৩

ছেলেটা এখন কলেজে পড়ে। বাংলার এক প্রথম সারির পত্রিকায় চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সুযোগ পেয়েছে সে। আজ তাঁর প্রথম আউটডোর অ্যাসাইন্মেন্ট। একটা বাংলা ছবির ‘প্রেস মিট’। ছবির নাম ‘রূপকথা নয়’। নায়কের ভূমিকায় তিনি।

তারপর অনেক ওঠাপড়া। বছর চারেক পর সাংবাদিকতার ‘মোহ’ ছেড়ে আরেকটা সংস্থার দশটা-সাতটার প্রযুক্তিবিদ হয়ে গেল ছেলেটা। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স চিত্র সম্পাদক। একটা ডিজিটাল সংগ্রহশালার প্রোগ্রাম ডেভেলপিং হেড।

কাট টু

দৃশ্য ৩

১২ জানুয়ারী, ২০২০

সাতদিন বাদেই তিনি পঁচাশিতে পা রাখবেন। ডিজিটাল সংগ্রহশালার উদ্যোগে তাঁকে অডিও চিঠি পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। সম্পাদকের ভূমিকায় সেই ছেলেটি।

কাট টু



দৃশ্য ৪

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে ছেলেটার অফিস এখন। সেই ডিজিটাল সংগ্রহশালা আরেক প্রবাদপ্রতিম কে নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রয়োজন তাঁর একটা ইন্টারভিউ। কিন্তু ইতিমধ্যেই খানিক অসুস্থতা গ্রাস করেছে তাঁকে। টেকনিক্যাল কর্মকর্তা হিসেবে ওই ছেলেটিকেই যেতে হবে। কিন্তু বিধি ছেলেটার দশটা-সাতটার শিডিউল। শহরের বাইরে থেকে ফিরে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা। এদিকে ওনার মেয়ে মিতিল দি বলে দিয়েছেন ন’টার মধ্যে তিনি নাকি ঘুমিয়ে পড়েন। অতএব প্রযুক্তিগত ব্যাপার স্যাপার আরেক সহকর্মীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ছেলেটা। সেবারও আর তাঁর সামনে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল সেট করা হয় নি ছেলেটার।

কাট টু

দৃশ্য ৫

১৫ নভেম্বর, ২০২০

ছেলেটার এডিট টেবিলে তিনি বসে আছেন, কথা বলছেন। অথচ গোটা শহর তাঁর শোকে সন্তপ্ত। ৪০ দিনের লড়াই শেষে আজ তিনি পাড়ি দিয়েছেন পরপারে।

তাঁকে নিয়ে ছেলেটার স্মৃতি কথা এখানেই শেষ হয়ে যাবে কিন্তু ছেলেটা জানে মানুষটা বারবার ফিরবে তার এডিট টেবিলে।

একটা অটোগ্রাফ থেকে ক্যামেরায় চোখ রেখে তাঁকে শুট করার সুযোগ, এই না পাওয়ার আক্ষেপটা সারা জীবন থেকে যাবে ছেলেটার মনে। ছেলেটার শৈশবের ফেলুদা, কৈশোরের ক্ষিদ্দা আর যৌবনের বিশ্বনাথ মজুমদার সে । প্রবাদপ্রতীম শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

 

বিঃদ্রঃ ছবিটা ‘রূপকথা নয়’-এর প্রেস মিটে তোলা

 

No comments:

Post a Comment