ঋতু পরিচয়

 

ঋতু পরিচয়



 
       সে দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। টুপ টুপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। ৩০ মে, ২০১৩, দিব্যি মনে আছে সেকেন্ড ইয়ার অনার্সের সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা দিয়ে ফিরেছি সবে, ভাই বলল, “দাদা খবর শুনেছ ?”
আমি বললাম, “কী?”
ভাইঃ ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা গেছেন!’
আমি বললাম, সে কী!
আকাশ থেকে পড়লাম। টিভিটা চালাতেই চ্যানেলে চ্যানেলে যেন একটাই খবর।
“প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ”

      
       কোথাও যেন বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন মিথ্যে কথা বলছে। এই তো দুদিন আগে টুইট করে বললেন যে ‘সত্যান্বেষী’-র শুটিং শেষ। আর আজ? তবে কী সত্যিই থেমে যাবে রোববারের ‘ফার্ষ্ট পার্সন’-এর কলম? ভিন্ন স্বাদের সম্পর্ক গুলো নিয়ে কী আর কেউ পর্দায় গল্প বলবে না? টিভিতে বলছে, ইন্দ্রানী পার্কের
বাড়ি থেকে দেহ নিয়ে যাওয়া হবে নন্দন চত্বরে, তারপর টেকনিসিয়ান ষ্টুডিও হয়ে শেষ কৃত্য সম্পন্ন হবে সিরিটি শ্মশানে, সেখানেই নাকি তাঁর বাবা-মা মায়ের দেহ বিলীন হয়েছিলমনে হচ্ছিল বাসে উঠে সোজা শোভাবাজার চলে যাই, তারপর মেট্রোয় রবীন্দ্র সদন। একে সারাদিনের পরীক্ষার ক্লান্তি, তার ওপর টিপটিপে বৃষ্টি। সন্ধ্যা হবু হবু। সাইকেল টা নিয়ে সোজা চলে গেছিলাম বন্ধু তায়নের বাড়ি। ও খবরটা আমার কাছ থেকেই শুনল প্রথম।

পুষ্প বনে পুষ্প নাহি, পদ্ম পুকুর ফাঁকা

       আসলে আমাদের দুজনেরই বড্ড প্রিয় ছিল এই মানুষটা। একসঙ্গে বসে দেখলাম তাঁর গান স্যালুট। দুজনেই ভাষাহীন। টিভিতে দেখছি ওনার ভাই (ইন্দ্রনীল ঘোষ) ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। তায়ন বলল, “এই বন্ধ কর। নেওয়া যাচ্ছে না”। টিভিটা বন্ধ করে সাইকেলটা নিয়ে আবার ফিরে এলাম বাড়িতে।  বড্ড মনে পড়ছিল কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের ‘এখন কুইজ’ অনুষ্ঠানের শুটিং-এর কথা। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হয়েছে সবে। একদিন সুযোগ পেলাম কলকাতা দূরদর্শনের ‘এখন কুইজ’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করার। শুটিং চলছে। মুক্ত প্রশ্ন। হাত তুললে সুযোগ। চলছে অডিও ভিশুয়্যাল রাউন্ড। একটা সিনেমার পোষ্টার দেখানো হল। জিজ্ঞেস করা হল সিনেমার নাম এবং গীতিকার-এর নাম। ঝপাঝপ হাত উঠল। অত হাতের ভিড়ে আমার হাতটা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল। সিনেমার নাম সবাই ঠিক বললেও গীতিকারের নামটা সবাই ভুলই বলছিল। কিন্তু শেষ সুযোগটা এল আমার কাছেই। উত্তর দিলাম নির্ভুল। সিনেমার নাম ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’, গীতিকার ঋতুপর্ণ ঘোষ। কুইজ মাষ্টার এবার ইয়র্কার দিলেন, ‘বলতে পারবেন কোন ভাষায় লেখা হয়েছিল গান গুলি?’ আমিও বাউন্ডারি হাঁকিয়ে বললাম, ‘ব্রজবুলি’ ভাষায়।  সঙ্গে সঙ্গে হাততালি। আর মেমেন্টো আমার হাতে। আসলে কী করে ভুলি, মায়ের পাশে বসে নন্দন ২-এ  দেখা আমার প্রথম সিনেমা 


       তখন ক্লাস সিক্স। প্রতি রবিবার বিকেলে ডিডি বাংলায় বাংলা সিনেমা দেখানো হত। সেখানেই একদিন দেখলাম ‘উনিশে এপ্রিল’। মা বলত, ‘উনিশে এপ্রিল’ নাকি অপর্ণা সেনের সিনেমা। তখন তো আর এত ফিল্ম ম্যাগাজিন ঘাঁটতাম না আর কথায় কথায় গুগল সহায়-ও ছিল না। সেদিন টাইটেল কার্ডে প্রথম দেখেছিলাম ঋতুপর্ণ ঘোষ নামটা। শান্ত, মৃদু চালের একটা সিনেমা শেষ দৃশ্যের পর মনে হল,  এ যেন শেষ হয়েও শেষ হল না।

ম্যাগাজিন থেকে

মনের ভেতর দাগ কেটে গেল সে ছবি। তারপর শর্ট টেষ্ট, হাফ ইয়ার্লি, ইউনিট টেষ্ট, অমুক স্যার, তমুক কোচিং, তুসুক ম্যাডাম করে মাধ্যমিকের বাধ্য ছেলে হয়ে কাটিয়েছি বেশ কয়েকটা বছর।
      
       ততদিনে টাক মাথা, নারীসুলভ আচরণে অভ্যস্ত মানুষটাকে টিভির পর্দায় দেখে ফেলেছি বেশ কয়েকবার। ক্লাস ইলেভেন তখন। কো-এডুকেশন। কেমিষ্ট্রি কোচিং-এ বসে চলছে স্কুলের ক্লাস বাংকের প্ল্যানিং। প্ল্যানিং মাষ্টার আরণী। প্ল্যান হল সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে। কী সিনেমা? না, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’। গ্রাম মফঃস্বলে যেখানে নুন শো কিংবা ম্যাটিনি শো-এ ‘এম.এল. এ ফাটাকেষ্ট’ কিংবা ‘রিফিউজি’ আর সাতটা কিংবা এগারোটার শো-এ ‘গরম জওয়ানী’র পোষ্টার পড়ে সেখানে তো আর এই সব সিনেমা আসে না তাই গন্তব্য ‘আইনক্স’। শোনা মাত্রই ওই প্ল্যানে জল মিশতে লাগল কয়েক সেকেন্ড। পয়সা খরচা করে ওসব ম্যান্দা মারা আর্ট ফিলিম তারা দেখবে না। আর আমাদের কয়েক জনের তখনও বন্ধু সহযোগে সিনেমা হলের প্রবেশাধিকার মেলে নি। কাজেই প্ল্যান ক্যান্সেল। দিন কুড়ি পরেই এক রাতে টিভির পর্দায় এলো সিনেমা টা। সপরিবারে দেখলাম। এ কেমন সিনেমার ভাষা! আবারও মুগ্ধ হলাম। পরে যেদিন আরণীর সঙ্গে দেখা হল, ওকে বললাম, “সিনেমা টা দেখলাম, কী দারুন রে”। ও এক এক করে বলল, ‘তিতলি’ দেখেছিস? ‘শুভ মহরত’? ‘খেলা’? ‘অন্তরমহল’? ‘দহন’? ওগুলো দেখিস।

       ‘দহন’ দেখি নি। পড়েছি। তখন খবরের কাগজ গুলো আজকের মত ঘটা করে সিনেমার পাতা বের করত না। আর বের করলেও ভিন্ন ঘরানার ছবি নিয়ে বেশী বাক্য ব্যয় করত না। সেই শুরু সত্যজিৎ-মৃনাল-তপনের পর বাংলায় অন্য ধারার সিনেমার প্রতি আকর্ষণ।  যত দেখছি তত সম্মোহিত হচ্ছি। ঋতুপর্ণ ছাড়িয়ে পরিচালকের লিষ্ট ক্রমশ বাড়ছে। তারমধ্যেই ষ্টার জলসায় শুরু হল ‘ঘোষ এন্ড কোম্পানি’
যেন নিজের ড্রয়িং রুমে বসে কেউ আড্ডা দিচ্ছে। সেখানেই একদিন দেখলাম ঋতুপর্ণ ঘোষকে ভীষণ রেগে যেতে। মীর কেন তাঁকে নিয়ে মস্করা করে? একদিন এক আত্মীয়ের বাড়িতে পেলাম ‘ফার্ষ্ট পার্সন’ ম্যাগাজিনটা। অবাক হলাম। এভাবেও পাঠককে প্রানের মায়ায় বেঁধে ‘সম্পাদকীয়’ লেখা যায়! ক্লাস টুয়েল্ভ যখন, রবীন্দ্রনাথের জন্ম সার্ধশতবর্ষে শুরু হল ‘গানের ওপারে’মেগা সিরিয়ালের সে কী ভিন্ন ভাষা! কত অজানা কে জানার এক মাধ্যম। নিজের কলমে নিজের সিনেমার আত্ম সমালোচনা। বাংলা, বাঙালি আরো কত কী! কিন্তু বিধি টি.আর.পি। হঠাত ঋতু পরিবর্তন। ভাষাও এলোমেলো।

পোর্টালের সম্মান


       তারপর প্রথম কলেজ কেটে নন্দনে সিনেমা দেখতে যাওয়া। চিত্রাঙ্গদা... দ্য ক্রাউনিং উইশ। এই ছবির রিভিউ লিখেছিলাম দু’বার। তাঁর প্রয়াণের পর। প্রথম রিভিউ এক সংবাদ পত্রে সাংবাদিক পদে ফ্রিল্যান্স করার সুযোগ দিয়েছিল। আর দ্বিতীয় রিভিউ দিয়েছিল পুরস্কার, একটি পোর্টালের তরফে। তাঁর প্রয়াণের পরদিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সবকটা নিউজ পেপার কিনে নিয়েছিলাম, আর্কাইভাল ভ্যালু হিসাবে। পরে পরে ‘আনন্দলোক’, ‘প্রথমা’, ‘ফার্স্ট পার্সন’, ‘রিডিং ঋতুপর্ণ’ সওওওব। জোগাড় করে ফেলেছিলাম ‘সানগ্লাস’ বাদে সবকটা ছবি এমন কী টেলিছবি কিংবা শ্রুতিনাটকেরও ডিজিটাল ভার্সন। পাইনি শুধু ‘দহন’
সেটাও দেখেছিলাম সে বছর ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালে, রেক্ট্রোস্পেক্টিভ বিভাগে, শিশির মঞ্চে বসে। কলেজের সেকেন্ড ইয়ার পাশের পেপারের পরীক্ষা দিয়েই ছুটেছিলাম নন্দন-এ। শেষ সিনেমার সাক্ষী থাকতে। ‘সত্যান্বেষী’ফার্ষ্ট ডে, ফার্ষ্ট শো। আশাহত হয়েছিলাম। যেমন ভালো লাগে নি ‘খেলা’ বা ‘জীবনস্মৃতি’বছর দেড়েক আগেও তাঁকে নিয়ে তৈরী তথ্যচিত্র ‘সন্ধ্যের পাখি’ দেখতে ছুটেছিলাম নন্দনে। ওই ছবির সম্পাদক আবার আমার সম্পাদনা শিক্ষার এক গুরু।

       তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর ব্যবহার, যৌনতা বোধ, নেপোটিজম ইত্যাদি অনেকেরই আলোচনার বিষয় বস্তু। কিন্তু তাঁর ছবি, রুচিবোধ, সাহিত্যমনস্কতা বারবার আকৃষ্ট করেছে তাঁকে আরো নতুন করে জানতে। সেই জানা আজও বহমান। তাঁর প্রয়াণের মাত্র দু’মাস পর সাংবাদিক হিসাবে আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ। আক্ষেপ একটাই। সাংবাদিক বা চিত্রগ্রাহক জীবনে একবারও সামনা সামনি পেলাম না মানুষটা কে।

       আজ একটাই প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে মানুষটাকে
আজ যেখানে আছেন সেখানে মায়ের হাতের পায়েস আর বাবার অনেক অনেক আদর নিশ্চয়ই মিস করেন না আর ?

সাতান্নতম জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে
ভালো থাকবেন


প্রীতম পাল
৩১ আগষ্ট, ২০২০

Photo Courtesy: Suman Dey Sarkar, Pritam Pal, Kolkata Movie Database, Prathama Magazine

No comments:

Post a Comment