মনে রাখবে রাজারহাট, প্রতিবাদী বিনিদ্র রাত


     পথের শেষে একটা ঘর, আর জি কর আর জি কর । শিল্পী অতনু বর্মন-এর থেকে ধার করেই শুরুটা লিখলাম। গতকালই এক দৈনিকের প্রথম পাতার লিড-প্যারায় পড়ছিলাম “দেশ স্বাধীন হয়েছিল এক ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে। ৭৭ বছর পর সেই দিনই পথে নামছেন এ রাজ্যের মেয়েরা। দাবী স্বাধীনতারই। স্বাধীন ভাবে, নির্ভয়ে বাঁচার। আর জি কর মেডিক্যালে চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে রাতের পথে নামার ডাক দিয়েছেন মেয়েরা। স্লোগান উঠেছে- ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ “।
রাত দখলের এই প্রতিবাদী কর্মসূচীতে পিছিয়ে রইল না আমার রাজারহাটও। বছর বারো আগে ঘরের মেয়ে কামদুনির অপরাজিতার বিচারের দাবিতে দফায় দফায় প্রতিবাদ দেখেছিল রাজারহাট। কিন্তু সে প্রতিবাদকেও পিছনে ফেলে ইতিহাসের খাতায় লেখা থাকবে গত রাতের কথা। ৩১ বছর ধরে আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবন কাটানো এই মফঃস্বলে কোনো নবমীর রাতে কিংবা দিপাবলীর রাতেও এমন জন-সমুদ্র দেখি নি। পুরো ভাগে রাজারহাটের মা-বোনেরা। পাশে রইলেন পুরুষরা। যদিও এই মিছিলে পুরুষের ভূমিকা একটু প্রশ্নের দিকেই।
    প্রতিবাদী জনতার সংখ্যাটা ঠিক কত? হাজার? দু’হাজার? তিন হাজার? পাঁচ হাজার? এই জনসমুদ্র কে সংখ্যায় প্রকাশ করা বড্ড কঠিন। কারন রাজারহাট চৌমাথা থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদী মিছিল রাজারহাট রোড ধরে যখন প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রেকজোয়ানী মোড়ে সার্ভিস রোডে পা রাখছে তখনও মিছিলের প্রান্তভাগ রাজারহাট স্টেশনের কাছে। গৃহকর্ত্রী থেকে পরিচারিকা, শিক্ষিকা থেকে ছাত্রী, তথ্য প্রযুক্তি কর্মী থেকে সমাজকর্মী, উদ্যোগপতি, মিলে গেল সবাই। কথা ছিল ঠিক রাত ১১টায় রাজারহাট চৌমাথা্য় জমায়েতের। আহবান ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই চৌমাথার আশে পাশে অনেক ছোট ছোট জমায়েত শুরু হয়। টোটো স্ট্যান্ডে ভিড়তে থাকে প্ল্যাকার্ড হাতে একেক প্রতিবাদী স্ফুলিঙ্গ। কেউ বিষ্ণুপুর, কেউ রাইগাছি, কেউ মনিখোলা, কেউ বা জামালপাড়া, কেউ পাথরঘাটা, কেউ লাউহাটি কেউ বা খড়িবেড়ি-লাঙ্গোলপোতা। কেউ এলেন শেষ বাসে, কেউ বাইকে চেপে, কেউ বা পায়ে হেঁটে। শেষ অবধি পরিষেবা দেবার কথা রেখেছিল টোটো ইউনিয়ন, কিন্তু কথা রাখে নি রাজারহাটের বাস ও অটো ইউনিয়ন। যেমন কাল অফিস ফেরত নবান্ন বাসের কন্ডাক্টর ভাই জানতেনই না যে সারা রাত কলকাতার কর্মসূচী কি হতে চলেছে। কথা ছিল সমাবেশে কোনও রাজনৈতিক রঙ থাকবে না। বারবার সে কথা মনে করাচ্ছিলেন উদ্যোক্তারা। স্বেচ্ছা-সেবকরা বারবার পরীক্ষা করছিলেন প্ল্যাকার্ডের লেখা। স্বেচ্ছা-সেবক উদ্যোক্তাদের এ হেন আচরনের হেতুও ছিল। কারন জমায়েত-এ এমন কিছু মুখ দেখা যাচ্ছিল যাদের রাজনৈতিক সহাবস্থান সবার জ্ঞানাতীত। কাজেই উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে আরো একবার মনে  করাতেই হল যে তাদের এই কর্মকান্ড সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। পাশাপাশি এও জানানো হল যে এই অভিযান মেয়েদের অভিযান, মিছিলের সামনে থাকুক মেয়েরা। কিছু পুরুষ পিছনে গেলেন। কিছু পুরুষ দখল করলেন রাজারহাট রোডের আরেকটি লেন। ভিড় সামলে রাতের ট্রাক, পন্য-বাহী যান নিয়ন্ত্রনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন রাজারহাট থানার কর্মীরা। চৌমাথার খোসলা ইলেক্ট্রনিক্সের সামনে টা তখনও অন্ধকার ঘুটঘুট করছে। এমন সময় উঁচানো প্ল্যাকার্ডের পাশে কয়েক হাজার হাতে জ্বলে উঠল মোবাইলের সাদা ফ্ল্যাশ লাইট, রাজারহাট চৌমাথা-র আকাশে বাতাশে ধ্বনিত হল সহস্রাধিক প্রতিবাদী কন্ঠের স্লোগান “We want Justice, We want Justice”। “বিচার চাই, বিচার চাই’। অপেক্ষা ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে-এগারোটা বাজার। দখল হবে  রাতের রাজারহাট।
    ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক সাড়ে-এগারোটা। প্রতিবাদী স্লোগান আর করতালিতে মুখরিত হতে থাকল গোটা রাজারহাটের আকাশ বাতাস। রাজারহাটের এমন রূপ আগে দেখেনি কেউ। মিছিল যত এগোল যোগ দিলেন রাজারহাটের আরো প্রতিবাদী নাগরিক। কেউ পঞ্চায়েত অফিসের সামনে থেকে কেউ বা পুরোনো বিডিও অফিসের সামনে থেকে কেউ আবার বিচুলিহাটা থেকে। সহস্রাধিক কন্ঠের প্রতিবাদে রাস্তার পাশে দাঁড়ালেন অনেকে। অনেক বহুতলের ব্যালকনি তে জ্বলে উঠল আলো, কোথাও কোথাও বেজে উঠল শঙ্খধ্বনি। মিছিলের পুরোভাগ সামলানেন রাজারহাটের অনন্যারাই। কেউ নৃত্যশিল্পী, কেউ সু-গায়িকা, কেউ কর্পোরেট কর্মী, কেউ ডাক্তার, কেউ স্বাস্থ্য কর্মী, কেউ বা কাজ করেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। স্বেচ্ছা সেবকের ভূমিকায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেখা গেল এক ঝাক ‘ইয়ং-রাজারহাট’-কে যাঁদের গায়ে সত্যিই এখনো কোনো রঙ লাগে নি। আট থেকে আশি পা মেলালেন রাতের রাজারহাট দখলে। মিছিলে উড়ল জাতীয় পতাকা। আর যাই হোক রাত পোহালে যে সূর্যোদয় তাতে সকলের রঙ ঐ তিরঙ্গাই।
    ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রাজারহাটের স্থানীয় এক সুইমিং পুলে ছিল সাঁতারের পরীক্ষা। সেখানে কিক-বোর্ড নিয়ে পরীক্ষা দেবার কথা ছিল স্থানীয় স্কুল শিক্ষকের দুই মেয়ের। পরীক্ষার আগের রাতে সেই বোর্ডেই প্রতিবাদের ভাষা সাঁটিয়ে দুই মেয়ের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সাঁতারের আরো কঠিন পরীক্ষা ছিল রাজারহাটের আরেক কন্যার। অমন পরীক্ষার আগের রাত ক্লান্তিময়, বিনিদ্র হওয়া মোটেই কাম্য নয়। তবু বিচারের দাবিতে মা-এর সঙ্গে গলা ফাটালেন তিনিও। বাবা হাঁটলেন পুরুষদের সঙ্গে। তাঁরাও বোঝালেন জীবনে অমন পরীক্ষা অনেক আসবে, যাবে কিন্তু মেয়েদের সুরক্ষা সবার আগে।
    মিছিল তখন রেকজোয়ানি মোড়ে সবে পা রেখেছে, অন্য লেন ধরে আসা পুরুষদের মধ্যে থেকে শোনা গেল কিছু বিক্ষিপ্ত স্লোগান। সঙ্গে সঙ্গে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট, “আমাদের কর্মকান্ডে বাইরের লোক ঢুকছে, ভলেন্টিয়াররা সতর্ক হও।” কিছু ভলেন্টিয়ার মিছিলের শেষ অবধি পৌছনোর চেষ্টা করলেন। না, আর কোথাও কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নেই। আছে শুধু চিৎকার। সে চিৎকারে মিশে আছে প্রতিবাদ। প্রতিবাদের দাবি একটাই, ‘বিচার চাই’। রেকজোয়ানি মোড় ছেড়ে স্যার রমেশ চন্দ্র মিত্র রোড ধরে মিছিল এসে পৌছালো আবার চৌমাথায়। ঠিক যেমনটা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। তারপর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে নতুন সুর্যোদয়ের ডাক।
    এক মাঘে যেমন শীত যায় না তেমনই এক প্রতিবাদে অপরাধীরা শাস্তি পায় না। কিন্তু প্রতিবাদের জোরে নিজেদের দাবি দাওয়া কে সামনে আনা যায়, ঘুন ধরা রাষ্ট্রতন্ত্রকে সাধারন নাগরিকের সামনে ভীত, সন্ত্রস্ত করা যায়। রাজারহাট সহ সারা কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা দেখিয়েছে তাদের প্রতিবাদী ভাবমুর্তি। কিন্তু এ প্রতিবাদ যেন হারিয়ে না যায়।
    রাজারহাটের মেয়েদের এই রাত দখলের লড়াইয়ের যে সাক্ষী রইলাম তা আমৃত্যু মনে থাকবে। রাতের রাজারহাটে পদচারণের অভিজ্ঞতাও এই প্রথম। সে জন্যই প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম রাতের রাজারহাট কী সত্যিই এতটা অন্ধকার? যাতে পাশাপাশি দুজনের মুখ দেখা যায় না? তাতে কার সুবিধা? যদি তাই হয় তবে রাজারহাটে আবার আন্দোলন হোক এই আঁধার কাটানোর জন্য। রাতের রাজারহাট-ও সুরক্ষিত হোক।


প্রীতম পাল
১৫ আগস্ট, ২০২৪

No comments:

Post a Comment