হ্যাপি ফাদার্স ডে


ছবিটা সত্তর কিংবা আশির দশকের উত্তর কলকাতার কোনও এক অ্যামেচার থিয়েটার-এর। ছুরি হাতে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে যে ছেলেটি অভিনয় করছে, গলপটা তাঁর। মঞ্চের বাইরের গল্প, জীবনের গল্প। হাওড়া জেলার কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে কাটানো শৈশব, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মায়ের সঙ্গে ছেলেটি যখন এই শহরে আসে তখনও শ্যামবাজারের মোড়ে নেতাজি ‘দিল্লী চলো’ বলেন নি। এই শহর দেখেও নি নকশাল আন্দোলন কাকে বলে।

     মা- দুই দাদা, যৌথ সংসারে তাঁর বেড়ে ওঠা। বাবাকে তাঁর মনে পড়ে না। দুই দাদাই তাঁর পিতৃতুল্য। চারজনের সংসারের ভার দুই অবিবাহিত দাদার ওপর। খেলাত বাবু লেনের দু’কামরার ঘরে মাথা গোঁজার ঠিকানা থাকলেও, মালিকানা ছিল অন্য কারোর। নিজের বলতে শূন্য, নিঃস্ব। তবে সে চোখে ছিল স্বপ্ন, মনে ছিল তাগিদ আর দেহে ছিল জোশ। কৈশোরের উচ্ছ্বলতায় উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি-কৃষ্টি
ক্রমশঃ আকর্ষণ করে তাঁকে। নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে পাড়ার ক্লাব ফুটবল আর নাটক কে। মেজদার ছিল একটা শখের আগফা ক্লিক থ্রি ক্যামেরা। সেই যন্তর খানাও বেশ টানত ছেলেটার কৈশোর মনকে। ট্রামের ঘণ্টার আওয়াজে, গুল-কয়লার ধোঁয়ায় সকাল হওয়া সেই কলকাতায় ছেলেটা ভোর হলে দুধ আনতে যায়- বাজার করে-পড়তে বসে, বেলা গড়ালে স্কুল, বিকেল হলে ফুটবল মাঠ কিংবা নাটকের মহড়া, সন্ধ্যে নামলে আবার পড়া তারপর আবার পরের দিনের অপেক্ষা। পড়াশোনায়ও মন্দ নয় সে। অঙ্কে নিরানব্বই? নৈব নৈব চ। এক্কেবারে একশোয় একশো। দাদাদের শাসনে স্ব-নির্ভরতার প্রাথমিক পাঠটা খুব ছোটবেলাতেই শিখেছিল সে। কাজেই নিজের কাজ নিজেই গোছাতে জানত সে।

     তারপর সংসারে এলেন নতুন বৌদি। বিয়ের পর ট্রাম লাইন ধরে, জলোত্তমা কলকাতায় উচ্চ শিক্ষার জন্য
তিনিও যেতেন কলকাতার উইমেন্স কলেজে। কিন্তু কে জানত বিয়ের একবছরের মাথায় তাঁর কপালে লেখা ছিল বৈধব্য যোগ? শনিবার, বিবাহ বার্ষিকীর ঠিক পরের দিনটাই বোধ হয়। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে আপার সার্কুলার রোড থেকে আসা এক পাঞ্জাব বডি লরির ধাক্কায় দাদা ছিটকে গিয়ে পড়েছিলেন আজকের কুমার্স কন্সার্নের দিকটায়। শনিবারের সন্ধ্যায় আর জি কর মেডিকেল কলেজে সেই দাদার দেহ শনাক্ত করলেন বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকা আরেক দাদা। লাশকাটা ঘরে ময়নাতদন্তের সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধুর হতে থাকল কিশোর ছেলেটার পায়ের তলার মাটি। ঝাপসা হতে থাকল স্বপ্ন গুলো। কারন ওই দাদাই তো ছিলেন সব স্বপ্নের দিশারী। স্বপ্ন গুলো থিতিয়ে গেলেও নতুন সংগ্রামের জেদটা বাড়তে থাকল। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব গিয়ে পড়ল আরেক দাদার ওপর। ততদিনে কলকাতা উত্তাল। শিক্ষিত-সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিপ্লবী সন্তানদের লাশ পড়ছে ময়দানের ঘাসে।

     মা আর দাদার সংসারে, পড়াশোনা, পাড়া-ফুটবল, নাটকের পাশাপাশি ছেলেটা দক্ষ হতে শুরু করল ব্রতচারী, সেন্ট জন প্রবর্তিত প্রাথমিক চিকিৎসা ও জরুরী চিকিৎসায়। এভাবেই নিম্ন মধ্যবিত্ত অভাবের সংসারে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন। ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু দাদার ওপর আর্থিক নির্ভরতার চিন্তা তাঁকে বাধ্য করল বানিজ্য বিভাগে যেতে। মায়েরও বয়স বাড়ছে। মাকে সাহায্যের জন্যও দরকার কাউকে। অতএব বিয়ে করলেন দাদা।

     এভাবেই স্কুল পেরিয়ে কলেজ। মাথায় নাটক আর ফুটবলের পোকা। পাশাপাশি হাতখরচার জন্য টিউশনি আর অডিট ফার্মে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ। পাড়ায় থাকতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথ বসুর মতন ব্যাক্তিত্ত্ব। এমনই একবার নাটক নামবে তাঁদের। ছেলেটা কিছু জানতে গিয়েছিল জগন্নাথ বসুর কাছে। কথাবার্তার পর জগন্নাথ বসু বললেন, “বাড়িতে কে কে আছেন?”
- মা, দাদা আর বৌদি
- কত বছর ধরে নাটক কর?
- স্কুল থেকেই।
- নাটক করা মানে জানো?
- না... মানে...
- ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

     বড্ড গায়ে লেগেছিল কথাটা। তারপর পেপারের একটা বিজ্ঞাপন তাঁকে ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞান’-এর দিকে আকর্ষিত করে। ছ’মাসের আবাসিক সার্টিফিকেট কোর্স। ফিরে এসেই অল্প মাইনের চাকরি। নিজের পায়ে দাঁড়ানো। কিন্তু গ্রন্থাগারিক হতে গেলে যে  ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞান’ নিয়ে পড়াশুনো করতে হয় সেটাই তো অনেকের অজানা। চাকরির প্রথম পর্বে পদে পদে অপমান, হেনস্থা। আবার নিজেকে প্রমান করার লড়াই। ততদিনে কলকাতার পর্ব চুকিয়ে দাদা বাড়ি করে এসেছেন শান্ত-নিরালায়।  কিন্তু ওই যে ছেলেটার জেদ। প্রথমে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতক, তারপর বানিজ্য শাখায়।

     ১৯৮২ সাল। দিল্লীর দরবারে তখন এশিয়াডের জন্য সাজো সাজো রব। পুজোর ঠিক পরে পরেই কলকাতার নিউ থিয়েটার্স ষ্টুডিও তে বাংলার প্রতিনিধি দলকে মহড়া দেওয়াচ্ছেন নৃত্য শিল্পী শম্ভু ভট্টাচার্য। সুর দিচ্ছেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। সেই দলেই মহড়া দিচ্ছে ছেলেটা। নভেম্বরের ১৯ তারিখ দিল্লীর যে মঞ্চে ইন্দিরা গান্ধী বসে আছেন সেই মঞ্চের সামনেই বাংলার দলের হয়ে ‘নবান্ন’ নাচে অংশগ্রহন করে ছেলেটা।

     অমন একটা অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করে নাচটাকে নিজের কেরিয়ার হিসেবে নিতেই পারতেন। কিন্তু নেন নি। ছিলেন অ্যানালগ ফটোগ্রাফি ও ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট-এ বিশেষ পারদর্শী। সেটাকেও কেরিয়ারের অঙ্গ করেন নি। ছাত্র জীবন থেকে চাকরী জীবনে এমন এমন অনুষ্ঠানের আয়োজকের ভূমিকায় ছিলেন যেখানে অংশগ্রহন করে গেছেন তৎকালীন স্বনামধন্য শিল্পীরা। তাঁর নাটক-ফুটবল তো সেই কবেই অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি ছিলেন তার লক্ষ্যে অবিচল। অসাধারণ নয়, সাধারণ হয়ে নিশ্চিত জীবনে বেঁচে থাকার লক্ষ্য। প্রৌঢ় বয়সে শিখেছেন কম্পিউটার। নিজে শিখে এসে বাড়িতে বসে শিখিয়েছিলেন তাঁর ছেলেদের। সাংস্কৃতিক পাঠ থেকে জীবন সংগ্রামের সহজ পাঠ, সবটাই তাঁর ছেলেরা শিখেছে তাঁদের বাবার থেকে। চাকরীর শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন স্কুলের গ্রন্থাগারিক নিয়োগে তিনি ছিলেন ‘অভিজ্ঞ’ পদে। বিনা সাম্মানিকে সামলেছেন মুক্ত বিদ্যালয়ের কনভেনর এবং কারিগরী শিক্ষার দায়িত্ব। বিভিন্ন নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার থেকে পোলিং অফিসার, মন্দ-ভালোয় মেশানো অভিজ্ঞতা তাঁর। চাকরী জীবনের শেষ নির্বাচন ডিউটি? বড্ড তিক্ত অভিজ্ঞতা।

     চাকরী থেকে অবসরের পর চলে গেছেন সব কিছুর অন্তরালে। নিজের ছন্দে জীবন যাপন তাঁর। যে জীবনে একদা ছিল নির্ভরতার অভাব, সেই জীবনই শিখিয়েছে জীবন সংগ্রামের পাঠ।
     নিজের বাবা নয়, দাদাকে ‘ফাদার ফিগার’ করে বড় হওয়া ছবির ওই ছেলেটা, যে আজও জীবনের সহজ পাঠটা সুন্দর করে শেখায় সে আর কেউ নয়, আমার বাবা।

     হ্যাপি ফাদার্স ডে, বাবা ।



©প্রীতম পাল
জুন ১৮, ২০২৩

#fathersday #happyfathersday #fathersdaybengali
#আমারবাবা #একবাবারকথা #myfather #mydad

No comments:

Post a Comment