‘মায়ের মত’ ভালো অনেকেই হয়। কিন্তু ‘মা’ তো ‘মা’-ই হয়






     জানো মা, পুরোনো অফিসের এক সহকর্মী এক সময়ে বলেছিল,বাড়ির মা যদি বসে যায়, সেই সংসার ভেসে যায়কথাটা সেদিন হাড়েহাড়ে বুঝেছিলাম যেদিন সকালে তুমি বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারলে নাকপালে হাত দিয়ে দেখলাম ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে, অক্সিমিটারের ডিজিট দু’টো নব্বই-এর ওপরে আর উঠছে নাবুঝলাম মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে তুমিও গা ভাসিয়েছ। ডাক্তার নেই, টেস্ট করাবার সুযোগ কমে যাচ্ছে, চারিদিকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের হাহাকার, আশে পাশের লোকজনের অসময়ে চলে যাওয়া, মৃত্যু মিছিল...... ঊফফ! সে কি দিন গেছে মা গোআমরাও কি তবে আক্রান্ত? আমি, বাবা কিংবা ভাই, আমাদের কারোরই সেই ভাবনার অবকাশ ছিল না। শুধু এটুকু জানতাম ঠিক সময়ে ঠিকঠাক জিনিস গুলো জোগাড় করতে হবে। খাবার, বাজার, ওষুধ, সিলিন্ডার আর মেডিক্যাল সাপোর্ট। লকডাউনের মধ্যে এগুলোর জন্য যখন দু’চাকা নিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেরিয়েছি, তখনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে তুমি চিন্তা করেছ সদ্য শেখা কাঁচা হাতের অপটুতা নিয়ে।  আসলে তোমরা, মায়েরা এরকমই হও। এখনও জানি রাত দশটা বেজে গেলে রুটিন মাফিক তোমার ফোনটা আসবেই। ফোনের ওপার থেকে তুমি একটা কথাই জিজ্ঞেস করবে, ‘কোথায় আছিস’?

     সবাই বলে আমি নাকি
একটু বেশী পরিবার কেন্দ্রিক। সেসব বোঝাতে ইংরাজিতে ‘ফিলিয়া’, ‘অ্যাডিক্সন’ জুড়ে কীসব টার্মস ব্যবহার করে। সেই কোন ছোট্ট বেলায় শীতের ছুটিতে হাত ধরে কলকাতা ঘোরাতে, বাসে যেতে যেতে বলতে, ‘ওই দেখ ওটা ভিক্টোরিয়া, ওটা বিড়লা তারামন্ডল......’। কখনও পরেশনাথ, কখনও নিউমার্কেট, কখনও অ্যাকাডেমি। আসলে তুমি যত না চিনিয়েছ, তার থেকে বেশী ভালোবাসতে শিখিয়েছ এই শহরটাকে। তাইতো এই শহরটাও আজ জেনে গেছে আমার প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় সব কিছু। ঠিক তোমার মত।


     পুরোনো অফিসের চাকরিটা যখন ছাড়ছিলাম, তখন একবারের জন্যও জিজ্ঞেস কর নি যে কেন ছাড়ছি।  তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। কথায় কথায় এখন মাঝেমাঝেই যখন ঐ অফিসের বন্ধুদের খবর জিজ্ঞেস কর, তখন দিব্যি বুঝতে পারি, তুমি সব জানো। তোমাকে বলতে হয় নি কিছুই
জানো মা, ফটোগ্রাফি কলেজের একটা আড্ডায় ম্যা’ম-ও এই কথাটাই বলেছিলেন, ‘মায়েরা সব বোঝে’। উঠতি বয়সে তখন কথাটার মানে বুঝি নি, আজ বুঝি।

 

     ছোটবেলায় হাত ধরে নিয়ে যেতে পাশের কালচারাল অডিটোরিয়ামে, কখনও বা সব পেয়েছির আসরে। কখনও কালচারাল কম্পিটিশনে। আমাদের মধ্যবিত্ত সংসারের সাংস্কৃতিক চর্চায় বাবা ছিল মেন্টর আর তুমি ছিলে সেই বহমান স্রোতের কান্ডারী। বইয়ের তাকে প্রাইজ গুলো দেখলে সেই স্মৃতি গুলো আজও জ্বলজ্বল করে।

     আমাদের নিয়ে সবকিছুতেই ছিল তোমার ভাবনাতীত আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। চাপা প্রতিযোগীতা। মফস্বলে বসে শহরের সঙ্গে। তালে তাল মেলাতে হাবে-ভাবে-নিঃশব্দে বলে গেছ, ‘পারতেই হবে, তোকে পারতেই হবে’। একটা সময়ে এসে হেরে গেছি। তোমাকেও হারিয়ে দিয়েছি ঐ প্রতিযোগীতায়। বিশ্বাস কর মা, নিজে হারিয়ে যাওয়ার থেকে ওই হেরে যাওয়াটা বড্ড জরুরী ছিল। প্রতিযোগীতাটা না থাকলে আজ জীবন হয়ত আরও অন্যরকম হত। জানি সেই প্রতিযোগীতার আগুনে আজও মাঝে মাঝে ধুনো পড়ে...... কিন্তু আমি তো ডোন্ট কেয়ার

     আজ ‘মাদার্স ডে’ তে তোমার সঙ্গে কোনও মাখো-মাখো গদগদ ছবি আর আপ্লোড করলাম না। লেবুর দাম যেভাবে ওঠা নামা করছে তাতে লেবু-লঙ্কায় খরচার পর গরচাও যেতে পারে কিছু।  তোমার জন্য বরং এই লেখাটাই রইল।

     আসলে কি জানতো ‘মায়ের মত’ ভালো অনেকেই হয়। তাঁরা আবার একলা পথ হাঁটার কারনও হয়। কিন্তু ‘মা’ তো ‘মা’-ই হয়। কোনও এক জ্বরের রাতে স্নিগ্ধ কোলে, শান্ত-শীতল হাতের ছোঁয়া, একশোটা রাগের কারন আর হাজারটা অভিমানের আশ্রয়।   

© Pritam Pal
08.05.2022

#mothersday #mothersday2022 #pritampal


No comments:

Post a Comment