উৎসব যাপন

 


     প্রতিবারের মত এবারেও পৃথুদের গ্রামের দুর্গা মন্ডপে পুজো হল। ঢাক বাজল। মাইকে গানও বাজল। তবু অন্য বারের মত নয়। এবার যেন একটু ম্যাড়ম্যাড়ে, একটু জৌলুস হীন।


     পৃথুদের গ্রাম পেরোলেই ধান মাঠ আর মাঠ পেরোলেই উঁচু উঁচু ইমারতের ঠোকাঠুকি
ওই ধান মাঠের দিগন্ত রেখায় সাদা কাশফুল গুলো এখনও তাদের মাথা দোলাচ্ছে আর পাশের ইট-কংক্রিটের জঙ্গলে যে হাসপাতাল কটা ছিল তাঁদের ব্যাস্ততাও পুজোর আগে খানিকটা কমে গেলেও ইদানীং নাকি আবার বেড়েছে পৃথুদের বাগানে এবারও শিউলি ফুটেছে নীল আকাশে প্যাঁজা তুলোর মত মেঘের চরাচর, তবু পুজো পুজো গন্ধটাই যেন ছিল না ওদের গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে

     ওদের গ্রামের মানুষ গুলো সবাই কেমন ঈর্ষা কাতর
একটা পুকুরের ঘাট, একটা রাস্তা, একটা ফুলের গাছ, একটা ছোট্ট জায়গা নিয়ে পায়ে পা ঠেকিয়ে ঝগড়া করে ওরা প্রতিবেশীর আনন্দে দুখী হয় আর তাঁদের বিপদে ছাদ থেকে ছাদে চর্চা করে কেউ পাশে দাঁড়ায় না কারও

     ঠিক যেমনটা দাঁড়ায় নি মাস পাঁচেক আগে যখন কোভিড তাঁর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গোটা দেশটাকে
সন্ধ্যের পর পৃথু যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরত তখন পাড়ার রাস্তা থেকে শুধু সারমেয় চিৎকার ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেত না সে শুনশান, থমথমে চারপাশ বাড়ি ঢুকে শুনত আজ অমুক বাড়ির লোক কোভিড পজিটিভ তো কাল তমুকের বাড়ির লোক হাসপাতালে ভর্তি এভাবেই একদিন অনাহুত অতিথি এলেন পৃথুদের দ্বারে পৃথুর মা কোভিড আক্রান্ত হলেন একদিকে কাছের মানুষের মৃত্যু ভয় অন্য দিকে পারিপার্শ্বিকের চোখ রাঙ্গানি পৃথু জানত এ লড়াই তাঁর একার, তাঁর পরিবারের একান্ত ব্যাক্তিগত

     পৃথু যখন ব্যাক্তিগত পরিচিতিতে অক্সিজেনের সিলিন্ডারটা জোগাড় করে বাড়ি ফিরছিল তখন ঠাওর করেছিল প্রতিবেশীদের স্বভাবগত কানাকানি, ফিসফিসানিটা অব্যাহতই আছে যেন পৃথুদের একঘরে করার উদ্যোগ। কিন্তু ওই যে বলে ‘ধর্মের কল’! তিন দিনও কাটল না। ঐ উদ্যোগীদের ঘরেই সংক্রমণ। খবরের কাগজে পড়া বা টিভির পর্দায় শোনা ‘গোষ্ঠী সংক্রমণ’ শব্দটার আসল ছবি নিজের চোখে দেখতে পেল পৃথু। পাশের বাড়ির দাদার নাকি অক্সিজেনের মাত্রা ৭০-এর নীচে নেমে গেছে। স্থানীয় নেতাকে ধরে দাদাকে পাঠানো হল হাসপাতালে। বিনা চিকিতসায় পরলোকে পাড়ি দিলেন পাশের বাড়ির জ্যাঠু। কোভিড-এর লক্ষন সারা শরীরে। কিন্তু বাড়ির লোক জানেনই না কী করনীয়। ঈর্ষাকাতর পাড়ায় সুবুদ্ধি দেবারও যে কেউ নেই। হাসপাতালের দিকে পা বাড়াল পৃথুর ছোটবেলার বন্ধু গোগোল, দুদিন বাদে ওঁর বাবা। পৃথুদের পাড়ায় তখন ঘরে ঘরে সংক্রমণ। চলে গেলেন ব্যানার্জীবাড়ির বড় কর্তা, ঘোষ বাড়ির নিমাই দাদু। হাসপাতাল থেকে যেন ফিরতেই চাইছেন না কেউ। পাশের গলির মিহির বাবু মাস ছ’য়েক হল দিল্লীতে আছেন মেয়ে চন্দ্রানীর কাছে। চন্দ্রানী খবর দিয়েছে, মিহির বাবুও আর নেই। এই সব খবর শুনতে শুনতে ক্রমশঃ দেওয়ালে পিঠটা ঠেকে যাচ্ছিল পৃথুর। তবু মাকে বাঁচাতেই হবে। যে কোনো মূল্যে। যদিও ভ্যাক্সিনের দু’টো ডোজই নেওয়া ছিল পৃথুর মায়ের, ক্রমশ উন্নতি হচ্ছিল শরীরেরতবুও যেন মন মানতে চায় না। কোভিড পরবর্তী শঙ্কাও গ্রাস করছিল তাকে এমনই একদিন পাশের ঐ দাদার বাড়ির আরেক সদস্য পৃথুকে জিজ্ঞেস করল “মা কেমন আছেন?”। পৃথু তো অবাক। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, আর ঘুরে দাঁড়াতে গেলে একজোট হতে হয়, এটা সে জানেএ কী তারই সূচনা? হিসাব মেলাতে সেদিন খুব অসুবিধা হচ্ছিল পৃথুর। ঠিক তার পরদিনই মায়ের খানিকটা শারিরীক উন্নতি আর বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডারের বিপুল চাহিদার জন্য সিলিন্ডারটা সে যখন ফেরত দিতে যাবে, শুনতে পেল পাশের বাড়ির ঐ দাদার স্ত্রী আর ওনার মেয়ের কান্না জড়ানো চিল চিৎকার। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছিল, দাদার হার্টের নাকি পঁচাশি শতাংশ ব্লক। ঘন্টা দুয়েক পরেই ঐ দাদার মৃত্যুসংবাদটা ছড়িয়ে গেল পাড়ায়। দোতলার বারান্দা থেকে পৃথু দেখল শেষ বারের মত দাদাকে দেখতে যাচ্ছে ওঁর বাড়ির লোক। পেছনে পড়ে রইল দাদার সাধের আম গাছটাগ্রীষ্মের দুপুরে টপাটপ আম পড়ছে রাস্তার ওপর। শুনশান রাস্তায় তবু কুড়োবার লোক নেই। দাদার পর পৃথুর ছোটবেলার বন্ধু গোগোলের বাবা।  কাকুও কেমন যেন হঠাতই নেই হয়ে গেলেনকিন্তু শেষ ধাক্কাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না পৃথু। খবর এসেছে, গোগোল-ও আর বাড়ি ফিরবে না। পৃথুর অন্ধ বিশ্বাস ছিল গোগোল ফিরবেই। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স ওঁরলড়াই করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল। এই লড়াইটাও ও জিতবে। কিন্তু পারল কই? সেদিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি পৃথু। মায়ের কোলে মাথা গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল ছেলেটা। শুধু একটাই ভয় ওকে গ্রাস করছিল, বরাদ্দ অক্সিজেন টুকুও কী শেষ হয়ে যাচ্ছে এবার? ওঁদের দিনও কি ফুরোচ্ছে তবে?  দিন পনেরো বোধ হয় সন্ধ্যার শাঁখ বাজে নি ওদের গ্রামে। তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে সবাই। তবু শোক ওদের ছায়াসঙ্গীহতে পারে সে প্রিয় জন বা প্রিয় বন্ধু। সর্বোপরী প্রিয় প্রতিবেশী। হোক না একটু কুচুটে, একটু ঈর্ষা কাতর, একটু ঝগড়ুটে।

        এবার পুজোয় ওদের ছেড়ে আনন্দ করতে কতটা কষ্ট হয়েছে গ্রামের মানুষগুলোর তা পৃথু জানে না। তবু বচ্ছরকার পুজো হয়েছে, ঢাক বেজেছে, গান বেজেছে, ভোগ বিতরণ হয়েছে। সবটাই অনাড়ম্বরে। তবু পুজো কমিটি যদি চাঁদার টাকায় একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার উদ্যোগ নিত......... । শিয়রে নাকি তৃতীয় ঢেউ। পৃথুও ঠিক করেছে পুজো হোক বা দীপাবলি, সাধের বাহারী আলো গুলো আর এবছর আর জ্বালবে না সে। আঁধারেই থাক ওঁর এবছরের উৎসব যাপন।


©
প্রীতম পাল
১৫ অক্টোবর, ২০২১

No comments:

Post a Comment