কুর্নিশ সুব্রত বাবু! আসল নায়ক তো আপনি !


সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ জুলাই, ২০১৯


        বছর পাঁচেক আগের এক শীতের সন্ধ্যার কথা। তখন সংবাদপত্রের বিনোদনের পাতায় ফ্রিল্যান্স করি। বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশে এক পরিচিত পি.আর.-এর শেষবেলার বেলার আমন্ত্রনে পৌঁছাই ধর্মতলার কাছে যমুনা ব্যাঙ্কোয়েটে। একটি ‘অনামী’ বাংলা সিনেমার সাংবাদিক সম্মেলন। ছবির পরিচালক তেমন নামীনন, কলাকুশলীরা-ও কেউকেটা নন। অতএব  তৎকালীন বড় বড় হাউসের সাংবাদিকদের দেখা নেই। তারমধ্যেই  একটি নামী ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার এক সাংবাদিক নামলেন গাড়ি থেকে। ব্যাঙ্কোয়েটে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ‘অ্যালবেলে’ পত্রিকা কিংবা ‘কেবল’ চ্যানেলের সামনে তিনিই তখন ‘জর্জমান’। বেশ ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে পরিচালকের বাইটস নিতে শুরু করলেন। প্রথম প্রশ্ন টাই ছিল এমন, ‘আপনার কেন মনে হয় যে আপনার ছবি দর্শক দেখতে যাবে?’ । প্রথম প্রশ্নবানেই  আহত পরিচালক কোনোরকমে পরিস্থিতি সামলালেন। খানিক দূর থেকে প্রশ্ন টা শুনে আমিও তাকিয়ে ছিলাম ওনার  মুখের দিকে। দু-তিন কথার বাইটস সেরে তার চিত্র-সাংবাদিককে রেখে ঐ সাংবাদিক ব্যাঙ্কোয়েট ছেড়ে চলে গেলেন। গোটা সাংবাদিক সম্মেলন-এ  অনুপস্থিত থেকে তিনি আবার ফিরেও এলেন ঠিক যখন ‘সুরা-সম্মেলন’ শুরু হয়েছে । সুরা সম্মলনে নামী ব্র্যান্ডের গ্লাস হাতে নিয়ে তাঁর এমন সম্ভ্রান্ত হাব ভাব যেন ঐ দামী সুরা তাঁর প্রতি দিনের সঙ্গী।  কিন্তু আশে পাশের একটু পোড় খাওয়া সহকর্মীরা জানেন আসলে শেষ কবে তিনি মাস-মাইনের মুখ দেখেছেন তিনি নিজেও জানেন না।
       
উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
যাই হোক
নামী মিডিয়ার এ হেন বাক্য বানে আহত ও ব্যাথিত পরিচালক গোটা সাংবাদিক সম্মেলন-এ দু চোখ হাত দিয়ে চেপে বসেছিলেন। তারপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যা বললেন তার মর্মার্থ হল এই যে ওনারা অনেক কষ্ট করে কোনো ষ্টারকাষ্ট ছাড়াই এই ছবি করেছেন। এই ছবির ওপরেই অনেক পরিবারের রুটিরুজি নির্ভর করে আছে। কিন্তু তৎকালীন ইন্ড্রাষ্ট্রির বড় বড় মাথাদের দাদাগিরির জন্য ছবির ঠিকঠাক এক্সিকিউশন কিংবা প্রমোশন করতে পারেন নি। ছবির মুক্তি যে ঠিক কবে তাও সেই মুহুর্তে কেউ বলতে পারেন নি। সামনে বসে থাকা সাংবাদিকদের তিনি আকুতি জানিয়ে বলেছিলেন, দয়া করে এই ধরনের ছোট বাজেটের সিনেমার পাশে থাকবেন। আপনারা না থাকলে আমাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে যাবে।
বিশ্বাস করুন, কোনও প্রেস কনফারেন্সে ছবির পরিচালকের মুখ থেকে এমন কথা কোনো দিন শুনি নি। ফিরে এসে গুনে গুনে চারটে লাইন লিখেছিলাম আর একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। কারন তারকা বর্জিত চলচ্চিত্রের জন্য এর চেয়ে বেশী জায়গা বরাদ্দ ছিল না। পাথর খাদানের শ্রমিকদের দূর্বিষহ জীবন ও কুসংস্কার ছিল সেই ছবির প্রেক্ষাপট। ছবিটার অন্যতম আকর্ষন ছিল সাঁওতালী ভাষায় গাওয়া দুটি রবীন্দ্রসংগীত।
        ছবিটার নাম ছিল “প্রবাহিণী”। পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দত্ত। আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার এগারো পাতার একটি খবরের শিরোনাম তিনি। সিনেমার জন্য নয়। গ্রাসাচ্ছদনের জন্য মাত্র সাড়ে ছ’হাজার টাকায় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করার জন্য। সুব্রতবাবু আপনাকে কুর্নিশ। অন্তত একটা বিকল্পের সন্ধান পেয়েছেন। লজ্জাটা আপনার নয়, লজ্জাটা ঐ রাজনৈতিক রং-এ রঙ্গিন ‘পদলেহনকারী’, ‘বোদ্ধা’ দের যারা সিষ্টেমকে মুষ্টিগত করে রেখেছে, যারা প্রাপ্য সম্মান দিতে জানে না।
        আর হ্যাঁ, আমার মত মানুষের কাছে আপনারাই কিন্তু ‘নায়ক’। আপনারাই আমাদের রুপোলি দুনিয়ার বাইরের জগতটা চিনতে বাধ্য করেছেন। আর বাধ্য করেছেন বলেই বুক বাঁধা স্বপ্ন গুলোকে কঠিন বাস্তবের কাছে বন্ধক রাখতে পেরেছি। আর সেই জন্যই হয়ত মাসের শেষে নিজের বা আপনজনের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে আস্থা, ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগার হাসি ফুটে ওঠে।

        আপনার এই অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটুক। কানাঘুষো শুনতে পাচ্ছি আজকের এই রিপোর্টিং-এর পর অনেকেই আপনাকে সিনে পাড়ায় ফেরাতে চায়। এবার জীবন আপনার, সিদ্ধান্তও  আপনার।

 


প্রীতম পাল
২৩ জুলাই, ২০১৯

No comments:

Post a Comment