‘হলুদ বাড়ির চিঠি’- সম্পাদকের কলমে




     


             
        সেটাও ছিল একটা হলুদ রঙের বাড়ি। আমার গেরস্থের বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল দূর। আমার শৈশব কৈশোরের সেরা সময় কাটানোর পীঠস্থান। আমার স্কুল বাড়ি। তখন ২০০৪ সাল। ক্লাস সিক্স-এ পড়ি। আমার হলুদ বাড়িটা ১২৫ বছরে পদার্পন করছে আর ঠিক তখনই টিভিতে না রেডিওতে শুনলাম একটা গানের লাইন ‘...... ইস্কুল বাড়ি দেখে তাড়াতাড়ি, সেখানে এখন বুকের ভিতর, সবুজ স্কটিশ ১৭৫-এ’।

কাট টু

        ২০১৬ সালের জুলাই মাসের শেষের এক সন্ধ্যাবেলা। হঠাৎ নীনা দির ফোন। নীনা দি মানে অভিনেত্রী নীনা চক্রবর্তী। সাংবাদিকতার জগতে যেদিন প্রথম পা রেখেছিলাম সেদিন থেকে আলাপ। সেই আলাপ যে কবে দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক হয়ে গেছে তা আমরা নিজেরাও বুঝি নি। ফোনের ওপার থেকে নীনা দি বললেন, “শোন না, স্কটিশ চার্চ স্কুলের ওপর একটা লো-বাজেট ডকু-ফিচার হচ্ছে, আনন্দবাজারের শনিবারের পত্রিকা পেজের যে দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় আছেন, উনি করছেন। স্পেশ্যাল অ্যাপিয়ারেন্সে আমি আছি। সামনের রোববার শুটিং আছে
একজন ক্যামেরা পার্সন দরকার, তুই একটু করে দিবি?” ‘স্কটিশ চার্চ’-এই নাম টুকুই যথেষ্ট ছিল। একবাক্যে হ্যাঁ বলে দিলাম। সেদিন আরো একবার কানে বেজে উঠেছিল বারো বছর আগে শোনা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় - শিলাজিতের গাওয়া গানটা ‘আমাদের স্কুল, আমাদের প্রান, ছড়াক শহর আমাদের গানে, আমরা স্কটিশ মিলেমিশে থাকি, ভালোবাসার টানে’, চোখের সামনে ভেসে উঠল হাতিবাগানের কাছে বিধান সরণীর হলুদ রঙের বাড়িটা। কিন্তু ভুল ভাঙল যখন পরিচালক মহাশয় স্বয়ং ফোন করলেন। এ বাড়ি সে বাড়ি নয়। এ হল বিডন স্ট্রিটের স্কটিশ চার্চের ছোট বাড়ি। মনে আছে প্রথম ফোনালাপে ওনাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। খানিকক্ষন কথা বলার পর তিনি বলেছিলেন, “অ্যাই শোনো, তোমার ঐ ‘স্যার’, ‘স্যার’ করাটা বন্ধ কর তো। ওরকম ‘স্যার’, ‘স্যার’ করলে অস্বস্তি হয়, কাজ করা যায় না”। সেই শুরু। সাংবাদিক, পরিচালক দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ‘স্যার’ থেকে হয়ে গেলেন ‘কাকু’ ।  দেবশঙ্কর কাকু।

        ৩১ জুলাই, ২০১৬। রবিবার। মানিকতলার মোড়ে মাদার ডেয়ারীর ঘড়ির ঠিক নীচে সকাল ৬:০০ টায় কলটাইম। শিডিউল অনুযায়ী সকাল বেলা গোটা উত্তর কলকাতা জুড়ে শুধু মন্তাজ শট তোলা হবে। ছবির শুটিং যদিও শুরু হয়ে গিয়েছিল ভোররাত থেকেই। ৬:০০ টার কলটাইমটা ছিল ‘আমি স্পেশ্যাল’। কারন?  ঐ যে- গহন রাজারহাট থেকে আমার আবাহন! ভোর থেকে ক্যামেরার দায়িত্ব সামলেছিলেন নীনা দির বেটার হাফ ইন্দ্র দা। গাড়িতে চেপে উত্তর কলকাতার গলি, তস্য গলি, চায়ের দোকান, বাজার-হাট, জলের কল, গঙ্গার ঘাট, শ্মশান, পার্ক, ফুটপাথ, রেলস্টেশন ঘুরে সে যেন কলকাতা উপাখ্যানের কোনো পর্ব রচনা করছিলাম আমরা। সেদিন ছিল আবার নীনা দির জন্মদিন। মিত্র কাফেতে পালন হল জন্মদিন। তারপরের লোকেশন স্কটিশ স্কুলের পাশের এক গলি। কাকুদের স্কুলবেলা থেকেই যার পোষাকি নাম ‘এয়ার কন্ডিশন গলি’। গলির দুপাশের দুটো বাড়ির মাঝের দূরত্ব বোধ হয় এক ফুট-ও নয়। সেখানেও মন্তাজ শট। পুরোনো বাড়িগুলোর ছাদ থেকে তোলা হয়েছিল বেশ কিছু টপ অ্যাঙ্গেল শট। সেই দৃশ্যগ্রহনে সে কি রোমাঞ্চ! স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল, অ্যালুমিনিয়ায়ের বাঁকানো অ্যান্টেনা, ছাদের রেলিং-এ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কোনো পরগাছা।  এমন ছাদে ক্যামেরা  সেট করে অপেক্ষা করছি কতক্ষনে কেউ একজন হেঁটে চলে যাবেন ঐ রাস্তা দিয়ে। হেঁটে চলার দৃশ্যগ্রহন করতে করতেই এমন একজন হেঁটে চলে গেলেন যেখান থেকে আমরা পেয়ে গেলাম ছবির প্রভাত ধর চরিত্রকে। কিন্তু সরু গলির সেই পথিকও জানলেন না কিভাবে তাঁর কষ্টসাধ্য, মূল্যবান হাঁটা
কে লেন্সবন্দী করে সিনেমার চরিত্র বানিয়ে ফেললাম আমরা। এরপর কাকুর বন্ধু সুদীপ বাবুর বাড়িতে খানিক ক্ষনের বিশ্রাম।  পরের লোকেশন গল্পের মত সেই ইস্কুল বাড়ি। পি বি দিদি আর নীহার বাবুর সিকোয়েন্স শুট। ছবির নায়ক সেই হলুদ বাড়ি। হলুদ বাড়ি মেন গেট টা সবে পেরিয়েছি চোখের সামনে ভাসতে থাকল আমার নিজের হলুদ বাড়িটার ছবি। সেই একই রকম উঁচু সিঁড়ি, কড়ি-বরগার ছাদ, লম্বা লম্বা সিলিং ফ্যান, পুরোনো সুইচ বোর্ড, লাল লাল মেঝে। ছবির চিত্রনাট্যের মত আমারও তো এমন একটা ইস্কুলবেলা ছিল, একটা শৈশব ছিল। শট নিতে যখন শুরু করলাম, সেই শটে কোথাও সেই নষ্ট্যালজিয়াটাও বোধ হয় মিলে মিশে এক হয়ে গেল। সেদিনের মত শুট শেষ। শুনলাম ছবির শুটিং-ও শেষ। কারন এর আগে  বেশ কিছুদিন ধরে শুটিং চলেছে। 

        এরপর দেখতে দেখতে বছর পেরোয়, কিন্তু হলুদ বাড়ির কোনো খোঁজ মেলে না। দেবশঙ্কর কাকুর সঙ্গে টুকটাক কথা হলেই জিজ্ঞেস করতাম, “কী খবর প্রোজেক্ট টার”? কাকু বলতেন, “ হবে, হবে”।  ইতি মধ্যেই কাকু আনন্দবাজারের চাকরি ছাড়লেন, অন্য পত্রিকার যোগ দিলেন। পাশাপাশি বইয়ের সম্পাদনা এবং নিজস্ব লেখালিখির কাজে যুক্ত হলেন। এরমধ্যেই একসঙ্গে আমরা বইয়ের প্রোমো করেছি, প্রেজেন্টশন ফিল্ম বানিয়েছি, কিন্তু হলুদ বাড়ির কোনো হদিশ নেই।
        তারপর গতবছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। আরেকটা বইয়ের প্রোমো নিয়ে মিটিং-এ বসেছি কাকুর বাড়িতে সেখানেই একটা ওষুধের কৌটো হাতে দিয়ে বললেন,  “এটা নিয়ে যেও”। আমি বললাম, ‘কী আছে’? কাকু বললেন, “হলুদ বাড়ি। এডিটটা তুমিই ধরো”। ওষুধের কৌটো খুলে দেখি গোটা দশেক কাগজ মোড়ানো পেনড্রাইভ। তার মধ্যে ছবির ফুটেজ। আর প্রত্যেক মোড়ানো কাগজে লেখা  দৃশ্য সূচি। বাড়ি এসে সব ফুটেজ দেখা হল, কিন্তু কাজ শুরুর আগে তো একটা বেসিক মিটিং চাই। এ কাজ, সে কাজ-এ মিটিং-ও হয় না। দেখতে দেখতে ২০১৮ সালটাও কেটে গেল।

       
২০১৯ এর জানুয়ারী মাসের এক সকালে অফিস যাচ্ছি। রাস্তায় হঠাৎ কাকুর ফোন। ফোনের ওপারে কাকু বললেন, “প্রীতম এবার সিরিয়াসলি কাজটা শুরু করতে হবে, বয়স হচ্ছে আমাদের। উইকেট পড়া শুরু হয়ে গেছে। ” আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, সামনের রোববার আসব’। কথা মত সেই রোববারে পৌঁছেও গেলাম কাকুর বাড়িতে। মিটিং শুরু হল। শুরু হল ‘হলুদ বাড়ির চিঠি’-র সম্পাদনার কাজ। সম্পাদনার কাজ করতে বসেও বারবার ফিরে যেতাম আমার ছোটবেলায়। বাবা মায়ের হাত ধরে চেনা পুরোনো কলকাতায়। অফিস থেকে ফিরে গভীর রাতে, কিংবা অবসর সময়ে সম্পাদনার কাজ করতাম আর পাঠিয়ে দিতাম কাকুকে। কাকু আবার বলে দিতেন তিনি কেমন চাইছেন। এভাবে কাজ করতে করতে আমাদের দু’জনেরই মনে হল কিছু দৃশ্য কম পড়ছে। আবার শুরু হল ছবির শুটিং। কাকুদের মানিকতলার বাড়িতে নেওয়া হল কিছু দৃশ্য। অবশেষে মার্চ মাসে শেষ হল আমার সম্পাদনার কাজ। এরপর প্রতীক্ষা ছিল দেবশংকর হালদারের সময় দেওয়ার।  দেবশংকর হালদারের ভয়েস রেকর্ডিং-এর পরেই কাজ শুরু করলেন সঙ্গীত পরিচালক সুমন্ত বসু। সব মিলিয়ে আগষ্ট মাসে ছবির কাজ সম্পূর্ণ হল। যার শুভ মুক্তি আজ। সেই হলুদ বাড়িতেই হবে ছবির প্রিমিয়ার। একটা সঙ্গীতময় কার্নিভ্যালের মাধ্যমে । 

আজ সত্যিই হলুদ বাড়ি থেকে আমার ছুটি নেওয়ার পালা।

প্রীতম পাল
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯



1 comment:

  1. কিছু কাজ থেকে কখনো ছুটি হয়না... মানুষের মনে থেকে যায় তার রেশ... ভাল লাগার সুক্ষ্ম অনুভূতি... ভাল থাকিস,ভাল ভাল কাজ করিস...

    ReplyDelete