![]() |
আলোক চিত্রঃ নবনীতা গিরি |
সে দু-এক যুগ আগের কথা। নগরায়নের দমকা হাওয়ায় প্রোমোটারী উন্নয়নের শ্যোন দৃষ্টি পড়ে নি এই রাজারহাটের ওপর। এই রাজারহাট মানে আজকের নিউটাউন-ও নয়। সরু পাকা রাস্তা, আর তার দু পাশে আম, জাম, কলা, কাঠাল, লিচুর বাগান। সরলতা আর আড়ম্বরহীনতাই ছিল যেখানকার মানুষের আপন ভাবের ভাষা। ভাদ্রের শেষে মাঠের ধারে কাশফুল কিংবা দূর থেকে ভেসে আসা শিউলির গন্ধ যেমন জানান দিত পুজো আসছে তেমনই দখিনা হাওয়ায় ভেসে আসা ঘেঁটু ফুল আর আমের ডালে নতুন মুকুলের গন্ধ আজও বলে যায় সামনে পয়লা বৈশাখ। আরেকটা নতুন বছর। আসলে ঈদ-রথ-পুজো আর পয়লা বৈশাখ ছাড়া পুরোনো রাজারহাট বাসীর আর কোনো উৎসব ছিল না আর আজও নেই। কিন্তু এ সবের মধ্যেই পুরোনো বাংলা বছরকে বিদায় আর নতুন বছর কে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠানটাই বোধ হয় এখানকার মানুষের একান্ত নিজস্বতায় ভরপুর। তাই দূর্গা পুজোর পরেই উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার আরেকটা অজুহাত এই বর্ষশেষ আর শুরুর সময়টা।
তখন সিটি সেন্টার, ইকোপার্ক কোথায়? রাজারহাটের মানুষ উৎসবে মাতত তার আপন ছন্দে। খাঁ খাঁ দুপুরে কোকিলের কুহু তানের পাশাপাশি পরিশ্রান্ত মানব কণ্ঠে ভেসে আসত “বাবা তারকনাথের চরনে সেবা লাগে”। ঝোলা কাঁধে, খালি পায়ে, গলায় পৈতে পেঁচিয়ে, মাটির ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়ানো কোনো সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর ডাক। গোটা চৈত্র মাস ধরে তাঁরা শৈব ধর্ম পালন করে। বাড়ি থেকে চাল, কাঁচা ফল সব্জি, টাকা গ্রহন করে তা অর্পন করতেন মহাদেবের চরনে।
তখন মোড়ে মোড়ে এত মন্দির ছিল না। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বাড়ির মহিলারা নীল-এর পুজো দিতে যেতেন শ্রী রাম খাঁ কালী মন্দির সংলগ্ন শিব মন্দিরে। বটের ছায়ায় ছোট্ট বাঁধানো মন্দির-এর শিব লিঙ্গে জল ঢালতে আসতেন দূর দূরান্তের মানুষ। মন্দির সংলগ্ন বিশাল মাঠে বসত দুদিন ব্যাপী চড়কের মেলা। তখন মাঠের ওপর বিভাজনী দেওয়াল তৈরী হয় নি। মাটির কলসী, বেতের ঝুড়ি, থেকে শুরু করে তালপাতার পাখা, মাটির পুতুল, মোটামুটি নিত্য প্রয়োজনীয় ঘর গৃহস্থালীর হরেক মালের সম্ভার। তখন না ছিল আজকের ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন এর মত ডোর টু ডোর সার্ভিস, না ছিল বিগ বাজার, স্পেন্সার্স-এর মত শপিং মল । এক দিকে যেমন সারা বছরের সাংসারিক জিনিস কেনা তেমনই অন্যদিকে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের মিলন ক্ষেত্র হয়ে উঠত এই মেলা।
ছোটবেলায় মা- বাবার হাত ধরে কালীবাড়ি কমপ্লেক্সের মেঠো আল পথ ধরে যেতাম ঐ মেলায়। আজকের বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রফুল্ল দেবী নার্সিং হোম ( যার আগেকার নাম ছিল স্পন্দন নার্সিং হোম) পেরোলেই চোখে পড়ত অন্ধকারের উৎস থেকে উঠে আসা এক মুঠো আলো । কানে আসত নাগর দোলার ক্যাঁচক্যাঁচানি, আর হাজার লোকের হই-হই-রই-রই কলতান। তারই মাঝে মেলার মাইকে কারোর নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা, আর সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের শক্ত করে হাত ধরা। মেলায় ঢুকেই সে যেন গোটা বিশ্ব সংসার হাতের মুঠোয় পাওয়া। আমার প্লাস্টিকের সাড়ে ছ’টাকার গাড়ি হোক বা মায়ের রুমাল, টিপের পাতা, চিনা মাটির কাপ প্লেট, কিংবা বাবার বাগান পরিস্কার করার নিড়েন, বা হরেক মাল পাঁচ টাকার আসর, বাদ যেত না কিছুই। মেলার ভিড়েই দেখা হয়ে যেত কত চেনা, আধ চেনা মুখের সঙ্গে। মুখোমুখি হলে একটাই কমন জিজ্ঞাসা, “ভালো আছো ?” কত নতুন নতুন সম্পর্কের খোঁজ মিলত এই মেলায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখতাম ছোটবেলার বন্ধুরা তাঁদের সদ্য হওয়া নতুন গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে মেলায় ঘুরছে। দূর থেকে চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু ভাবটা এমন যেন কেউ কাউকে দেখে নি। কারন তাঁর সদ্য হওয়া ‘ইস্পেসাল’ বান্ধবীটি যে রাজারহাটবাসী, আমাদেরই কমন বন্ধু। আবার বয়সন্ধি কালের কোচিং পিকনিক কিংবা স্কুলের কালচারাল অনুষ্ঠানে ক্রাশ খাওয়া কোনো দিদির সিঁথিতে মোটা সিঁদুর আর পাশে কোনো এক সৌম্যকান্তি কে দেখে মনে মনে বলা, “যাঃ, এর কপালটাও ফাটল !” মেলা ঘোরার শেষে ছিল জিলিপি, কাঠি ভাজা, কটকটি হাতে মাঠের খোলা যায়গায় বসে হাওয়া খাওয়া নাহলে এর ওঁর সঙ্গে কথা বলা। দূরদূরান্তের মানুষ তাঁদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস সাজিয়ে ঘরে ফিরতেন। কারোর কারোর পশরায় আবার থাকত মাটির লক্ষী গনেশ, লাল চেলী আর বাঁধানো খাতা। রাত পোহালেই পয়লা বৈশাখ। বাংলার নতুন বছর।
নববর্ষের ভোর মানেই বিগত ঊনচল্লিশ বছর ধরে আমাদের রাজারহাটের জগদীশপুর গ্রামের ঘুম ভাঙ্গাতো যে অ্যালার্ম তা আজও তার স্বমহিমায় বর্তমান। পয়লা বৈশাখ মানেই এখানকার মানুষ বোঝে আট প্রহর ব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন। স্কুলমাঠ থেকে মাইকে আসা পুরুষালি গলায় ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’-ই জানান দেয় আজ বছরের প্রথম দিন। আমার জ্যেঠু তাঁর যুবক বয়সে এই অষ্টমপ্রহর কমিটির সদস্য ছিলেন। জ্যেঠুর কাছে থাকা কোনো এক বছরের একটা জাবদা খাতায় অনুষ্ঠানের শিরোনাম লেখা ছিল দেখেছিলাম ‘পয়লা বৈশাখ’। পয়লা বৈশাখ মানে যেখানে গোটা বাংলার মানুষ তাঁদের বাঙালি খাওয়া দাওয়ায় মেতে ওঠে সেখানে অষ্টমপ্রহরের জগদীশপুর আজও খায় নিরামিশ খাবার ।
পয়লা বৈশাখের সকালে ছ’টা বাজলেই আমাদের বাড়ির প্রতি বছরের রুটিনে ধরা বাধা ছিল ডিডি বাংলার নববর্ষের বৈঠকী অনুষ্ঠান। পঙ্কজ সাহা, চৈতালী দাশগুপ্ত, শ্বাশ্বতী গুহ ঠাকুরতার মিলিত কণ্ঠে বলা ‘শুভ নববর্ষ’ আজও কানে লেগে আছে। বেলা বাড়লেই এ দোকান সে দোকান থেকে ভেসে আসত কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। সাদা রজনীগন্ধা ফুল ক্রশ করে মাঝে মাঝে গোলাপ কিংবা সূর্যমুখীর চেন-এ সেজে উঠত দোকান গুলো। সকালে লক্ষী গনেশ পুজো আর বিকেলে হাল খাতা। আর হালখাতা মানেই দোকানে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা পানীয় খেয়ে মিষ্টির প্যাকেট হাতে বাড়ি ফেরা।
পয়লা বৈশাখের পরের দিনটা আমাদের জগদীশপুর বাসীর কাছে ভীষণ স্পেশাল। অষ্টমপ্রহরের নিমাই কোলে নগরকীর্তন বেরোয় ঐ দিন। গোটা গ্রামের মানুষের মিলন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে ঐ অনুষ্ঠান প্রাঙ্গন। দুপুরের কুঞ্জভঙ্গ, মালশা ভোগের পর রাতের বেলা গোটা গ্রামের এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়ায় মেতে ওঠা। তারপর আবার নতুন বছরে ভালো থাকার আশা বুকে বেঁধে আবার আরেকটা বছরের অপেক্ষা নিয়ে পুরোনো ছন্দে ফিরে যাওয়া।
তবে উন্নয়নের জোয়ারে রাজারহাট আজ গ্রাম থেকে শহরতলী। অলিতে গলিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ফ্ল্যাট বাড়ি। কত নতুন নতুন মানুষের আগমন হয়েছে এখানে। এখন কার ফ্ল্যাট কালচারে সন্ন্যাসীরা আর ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়ায় না। বন্ধ হয়ে যাওয়া গীতশ্রী সিনেমা হলের উল্টোদিকের মাঠে অন্নপূর্না পুজোটা আজও জাঁকজমকের সঙ্গে হয় কিন্তু আকাশ চুম্বী ইমারতের গা ঘেঁষাঘেঁষিতে জৌলুষ হারিয়েছে সিনেমা হলের পাশে পুজো উপলক্ষে হওয়া মেলা টা। চড়কের মেলাতেও দিনের বেলা আর গাজন বসে কি না জানা নেই। কালীবাড়ি কমপ্লেক্স নামটা আজও আছে কিন্তু সেই কমপ্লেক্স ধরে কালীবাড়ি যাবার রাস্তাটা আজ গোলকধাঁধায় ভরা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, পাড়ায় পাড়ায় এখন অনেক মন্দির। সবাই আর কালীবাড়ি যান না নীলের পুজো দিতে। আমাদের পাড়ার নগরকীর্তন-ও ক্রমশ হারিয়েছে তার আয়তন । আগের মত হালখাতা আর করেন না দোকানি রা। কাছাকাছি মন্দিরে পুরোহিত দিয়ে লক্ষী-গনেশ পুজো করিয়ে নেন তাঁরা। হালখাতায় না কি সেভাবে ধার আদায় আর হয় না তাঁদের। বরং খরচের বহর বেড়ে যায়। এভাবেই শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে রাজারহাটের বুকে তরুন হই আমরা। থেকে যায় স্মৃতিরা, বদলে যায় ইতিহাসের রাজারহাট।
প্রীতম পাল
১৩ এপ্রিল, ২০১৯
No comments:
Post a Comment