আরেকটা শৈশব স্মৃতির অপমৃত্যু
![]() |
২/১৮২, বিজয়গড়। ২৩ জানুয়ারী, ২০১৯-এর সকালে তোলা ছবি |
“সারাদিন দোলনায় দোল খেলে চলবে?” মাসির ধমকে টনক নড়ত। অতএব তানির কিশলয়, সহজ পাঠ, নব গণিত মুকুল নিয়ে চুপচাপ পড়তে বসে যাওয়া। কিন্তু বসলে কী হবে, মন যে ওই দোলনাতেই দোদুল্যমান ।
২০০২ সাল। ক্লাস ফাইভে অ্যাডমিশন টেষ্টের সময়। শীতের ছুটিতে মা জোর করে পাঠিয়ে দিলেন ওঁদের বাড়িতে থেকে কয়েক দিন পড়াশোনা করার জন্য। অ্যাডমিশন টেষ্টের প্রস্তুতি। মামদিদি, তানির পাশে বসতাম সঙ্গে থাকত পি.কে. দে সরকার, কে.সি. নাগ নামাঙ্কিত কিছু ‘টেনশন’ পেপার।
ওঁদের ছিল যাদবপুর বিদ্যাপীঠ, আর আমার স্যার রমেশ ইন্সটিটিউট। লড়াইটা চলতই। সঙ্গে চলত চাপা কম্পিটিশন। বলা ভালো খানিকটা শহরের সঙ্গে গ্রামের। আর আমি ছিলাম হেরোর দলেই। যখনই যেতাম ওই বাড়িতে দেখতাম বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে আছে ওরা দুই বোন। হয় মাসি, নয় মেসো, কেউ না কেউ পড়াচ্ছেন । একসময় তো মজা করে আমরা ভাইবোনেরা বলতাম যে ওঁরা তো জেলের কয়েদি, কাক-পক্ষীও ওঁদের মুখ দেখে না। পড়াশোনার মধ্যে থাকলেও নানান টিভির অনুষ্ঠান, গানের রেওয়াজ, খেলাধূলা থেকে ওরা বঞ্চিত ছিল না। মনে আছে একবার ২৫ ডিসেম্বর ওদের সঙ্গে বসে ছোট্ট ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিটায় প্রথমবার ‘দামু’ সিনেমা দেখার কথা। অনেক ছোটবেলায় মাসির হাত ধরে ভারত মাতার পুজোয় গেছিলাম আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতে। বিকেল হলে যেতাম গলফগ্রীনের সেন্ট্রাল পার্কে। সেন্ট্রাল পার্ক থেকে দেখতাম দূরদর্শন কেন্দ্রের সম্প্রচার অ্যান্টেনাটা। তখন ভীষণ জানতে ইচ্ছা করত দূরদর্শন কেন্দ্রের ভেতরে কীভাবে কাজ হয়? সেই ইচ্ছাই পরবর্তী কালে খানিকটা পুষিয়ে দিয়েছিল আমার ‘যোগ বিয়োগ’ আর ‘এখন কুইজ’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন ।
দেখতাম অবসরে বসে মামদিদি কি সুন্দর সুন্দর গ্রিটিংস কার্ড বানাচ্ছে। কোনোটায় অয়েল প্যাষ্টেলে এক মুঠো আকাশ, তো কোনোটায় জল রঙের পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর তৈরী রাজহাঁস। তানি খুব ভালো সাঁতার কাটত। কাপ- মেডেল-প্রাইজে ভর্তি ছিল ওই বাড়ির একটা কাঠের আলমারি। ছিল একটা বিশাল রান্নাঘর। রান্নার পরে গোটা দশেক লোক একসঙ্গে পাত পেড়ে বসে খেতে পারত। পরে অবশ্য মেসো ঐ রান্নাঘর রিনোভেট করে অনেক আধুনিক করে ফেলেছিলেন। আয়তন হারিয়েছিল সেই রান্নাঘর। মাসির বাড়ির সামনের আম গাছটা ছিল আমাদের মস্করার বিষয়বস্তু, কারন আম ছিল যেমন টক তেমনই ফলের পুরোধা জুড়ে থাকত আমের আঁটি । ওই বাড়ির প্রবেশ দ্বার আর সামনের এক চিলতে বাগান সেজে থাকত লাল লিলি ফুলে।
মাসির বাড়ি থেকে বিজয়গড় বাজার ছিল মাত্র তিন মিনিটের হাঁটা পথ। সকালেই সেই বাজার থেকে মাছ এনে স্নান করতে গেছেন মেসো, অফিস যাবেন বলে। মাছ কেটেকুটে মাসিও রান্না চাপিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ মাসির মনে পড়ল যে রান্নায় একটু ধনে পাতা দিলে বোধহয় ভালো হত। এদিকে কড়াইের ঝোলে মাছ ফুটছে আর জুতো গলিয়ে মাসি ছুটল ধনে পাতা আনতে। আর রান্নার পর সেই মাছের ঝোলের স্বাদ? লাজবাব!
![]() |
লিন্টন কাঁধে কাঁধ ঠেকাচ্ছে |
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডী পেরিয়ে একদিন বাড়িটায় গিয়ে
বুঝলাম দম বন্ধ করা পরিবেশটা অনেক টা হাল্কা হয়ে গেছে। নানান সাইজের কাঠের স্কেল
হাতে পড়া ধরার থেকে বেশী মাসি মেতে গেছেন হরিনাম সংকীর্তনে । সেই
সময়ে মাসির বাড়ি গেলেই জুটে যেত কোনো না কোনও ঠাকুর বাড়ির সুস্বাদু ভোগ। কখনো
খিচুড়ি, কখনো ফ্রায়েড রাইস, কখনো বা লুচি আলুরদম, কখনো আবার রাম ঠাকুরের আশ্রমের
সিন্নি-পায়েস । ততদিনে খোলা আকাশে অনেকটা ডানা মেলেছে
মাম-তানি দু’বোন। তারপর একদিন শুনলাম
মামদিদির বিয়ে। গোল ফ্রেমের পাওয়ার ওয়ালা চশমা পড়া যে
মেয়েটার বই ছাড়া অন্য কোনও
জগত ছিল না, স্বপ্ন দেখত অনেক বড় কিছু করার, দশের মধ্যে এক হবার, সেই মেয়েটার নাকি
বিয়ে। আসলে মেসোর শরীর দিনে দিনে খারাপ হচ্ছিল। বিয়েতে মেসো যদিও বেশ কয়েক ফোঁটা
চোখের জল ফেলেছিলেন তবুও একা হাতে সামলেছিলেন গোটা অনুষ্ঠান। মনে আছে আষাঢ় মাসের বৃষ্টিতে
ভিজে এই বাড়ির দরজায় আমি আর পিলু দ্বারঘট বসিয়েছিলাম। মামদিদির বিয়েতে সে কী আনন্দ
আমাদের ভাইবোনেদের । নেট ঘেঁটে
কুর্তা-পাঞ্জাবীর ডিজাইন বের করা, নতুন ক্যামেরায় ছবি তোলা , বিয়ের আসরে নতুন
জামাই বাবুর জুতো লুকোনো, আর বাসররাতের পর সকালবেলা শয্যা তোলার জন্য দাবী করা চড়া দক্ষিনায় বরপক্ষ যে একবাক্যে রাজি হয়ে যাবে তা আমাদের
কল্পনারও অতীত ছিল। নবদ্বীপে কনে যাত্রী যাবার সময় টুরিস্ট বাসে সে কী উদম নাচ
আমাদের ভাই বোনেদের। নবদ্বীপে সারারাত জেগে কত হাসি-ঠাট্টা, খিল্লি ওড়ানো।
![]() |
মাম দিদির বিয়েতে বরসজ্জা |
![]() |
পুকুলুর সঙ্গে |
প্রীতম পাল
১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯
১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯
Jst wao....purano smriti..
ReplyDeleteBah....
ReplyDeleteAsadharon.....sotty anekekichu abar mone pore gelo...
ReplyDelete