অ্যাই মেয়েটা, নাম কী রে তোর?


 অ্যাই মেয়েটা,  নাম কী রে তোর?



নাটকঃ নাম কী রে তোর
            কলেজবেলায় আমাদের এক শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের বয়সের পার্থক্য যে খুব বেশী ছিল এমনটা নয়, বরং তাঁর সঙ্গে ছাত্র  শিক্ষক সম্পর্কের থেকেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশী। চলনে বলনে , মেলামেশায় তিনি ছিলেন যেমন উৎফুল্ল তেমনই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অন্য অনেকের থেকে আলাদা, অনেক আধুনিক। একঝটকায় মনেও হত না যে তাঁর একটা সংসার আছে। তিনি কারোর স্ত্রী। কারন ম্যারাইটাল ষ্ট্যাটাসে ‘ম্যারেড’ বাটনে ক্লিক করার জন্য বাঙালি মহিলাদের যে যে বাহ্যিক  বৈশিষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয় বলে সমাজের সংবিধানে নানান ধারা বর্নিত আছে সেগুলি তাঁর মধ্যে কদাচিত দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিয়ের পর তিনি তাঁর নিজের পদবী বদলান নি। ভোটার তালিকা থেকে নিজের নাম স্থানান্তর করেন নি। তিনি যখন বলতেন “এবার বাড়ি যাব”, আমরা বুঝতাম উনি ওনার বাপের বাড়ির কথা বলছেন। পতিগৃহের চেয়েও পিতৃগৃহ ছিল তাঁর শান্তির আশ্রয়। তাঁর ঘরের পর্দা, ড্রেসিং টেবিল, বারান্দা, ছাদ যে কিভাবে তাঁর জীবন জুড়ে ছিল তা বারেবারে ফুটে উঠত আমাদের আড্ডায়, তাঁর কথায়। 
                                             আমার ঐ শিক্ষিকা সমাজের চিরাচরিত আবেগে নিজেকে ভাসিয়ে দেন নি। তিনি নিজেই নিজের শর্তে বাঁচার লক্ষে অবিচল ছিলেন এবং এখনও আছেন। কিন্তু এই একশো কোটির দেশে ক’জন পারেন এভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে? যেমন পারেন নি ‘কল্পনা’ প্রোযোজিত নাটক “নাম কী রে তোর” –এর প্রত্যুষা। প্রত্যুষার চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন, পড়াশোনা করবে, ভালো নৃত্যশিল্পী হবে, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবে।কিন্তু সেই স্বপ্নে জল ঢেলে তাকে স্কুলের চৌহদ্দি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান-এ ভর্তি করে দেয় তাঁর পরিবার। আরেকটা পরিবার পায় সে। নতুন ঘর, নতুন কিছু আত্মীয় আরো নতুন কিছু...। সুখ, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, ভালোবাসা কী নেই তাঁর কাছে ? সবই তো আছে। আর কী চাই? পাওয়ার কী  বাকি আছে কিছু? আসলে প্রত্যুষা পেয়েছে যা তাঁর চেয়ে হারিয়েছে অনেক বেশী কিছু। হারিয়ে গেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর বেলা। হারিয়েছে তাঁর আসল নাম। তাহলে প্রত্যুষা কে? এ নামে তো তাকে তাঁর ছোটবেলার বন্ধুরা চেনে না। তাহলে প্রত্যুষা কার নাম? উত্তর আছে নাটকে।
      নাটকের এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল আমার দূর
সম্পর্কের এক বৌদির কথা। ছোট থেকে আমরা সবাই জানতাম ওই বৌদির নাম দীপা। সেই নামেই তাকে সবাই চেনে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বউদি বললেন তাঁর এই নাম নাকি বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে দেওয়া হয়েছিল। ভাবুন গোটা দেশের
নিবন্ধগ্রন্থে তিনি যে নামে পরিচিত সেটা তাঁর আসল নাম নয়, সাহাপুর গার্লস-এর রেজিষ্টার খাতায় দীপা নামে কেউ নেই। দীপার প্রতিরুপী যে ছোট্ট মেয়েটা আছে তার নাম প্রতিমা। বিয়ের পর শ্বাশুড়ি দেখলেন নিজের মেয়ে আর বৌমার নাম এক। একই নামে তো আর দুজন কে ডাকা যায় না! আর মেয়ে আর বৌমা এক হয় নাকি?  অতএব বলির পাঁঠা কর বৌমাকে। সে আমলে বিয়েতে রেজিষ্ট্রি হত না। আর বিয়ের বয়স? থাক, নাই বা লিখলাম সেটা ।
নাটকঃ নাম কী রে তোর

      আসলে কল্পনা প্রোযোজিত “নাম কী রে তোর” নাটকএর প্রতিটা দৃশ্য আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিটা মেয়ের জলছবি, যেখানে কন্যা সন্তান জন্মালে পরিবার দায়গ্রস্ত হয় আর পিঠোপিঠি পুত্র সন্তান থাকলে সে হয় ‘সোনার আংটি’, যে নাকি আবার বাঁকা হয় না কখনও। একাকী অভিনয়ে অভিনেত্রী কল্পনা বড়ুয়া যেমন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নারীর শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধি ও যৌবনের প্রতিচ্ছবিকে তেমনই অরিজিত রায় তাঁর সংলাপের তীক্ষ্ণতায় সপাটে চড় মেরেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়মরিতী কে । প্রতিবাদ জানিয়েছেন পরিবারতন্ত্রের বহমান রুচী ও রক্ষনশীলতার বিরুদ্ধে। নাটক শেষেও যার রেশ থেকে যায়,  কাঁটার মতো বারে বারে বুকে এসে বেঁধে সংলাপ গুলো।
     
লেখাটা এখানেই শেষ করব ভাবছিলাম। হঠাতই এক ফিল্মপাগল বন্ধু হোয়াটসঅ্যাপে একটি বাংলা ছবির প্রোমোশোনাল টিজারের লিঙ্ক পাঠাল। ছবির নাম ‘মুখার্জি দার বউ’। সেখানেও দেখলাম সেই একই সংকট, একই কথা, আমার আপনার মা-বোন, দিদি-বৌদি, জ্যেঠি-কাকি, পিসি-মাসির কথা। যা কখনো প্রকাশ পায় কখনো বা অব্যক্ত থাকে।


প্রীতম পাল
২৪ জানুয়ারী, ২০১৯

No comments:

Post a Comment